কিছুদিন আগে আমি বিশেষ প্রয়োজনে আমার পরিচিত একজনের বাড়ি গেছিলাম। ভদ্রমহিলাকে আমি বৌদি বলে ডাকি। তাঁর মেয়ের বছরখানেক হল বিয়ে হয়েছে এবং (আমি যেদিন গেছিলাম তার) আট দশ দিন আগে বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চা হবার আগে সে বাপের বাড়ি আসে, তারপর স্থানীয় একটি হাসপাতালে তার বাচ্চা হয়, সিজারিয়ান অপারেশন করে, তার পর সে হাসপাতাল থেকে শ্রীরামপুরে তার শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। তার বাড়ি গিয়ে দেখি, তিনজন হিজড়ে এসে উপস্থিত। খুব জমকালো সাজসজ্জা করে এসেছে। চকমকে শাড়ি, মেকআপ, লিপস্টিক, আই লাইনার, কোনকিছুর ত্রুটি নেই, একজনের কাঁধে দড়িতে বাঁধা ঢোলক। তারা বৌদির কাছ থেকে মেয়ের বাচ্চা হবার জন্য দুই হাজার টাকা দাবী করছে। বৌদি টাকার পরিমান কমানোর জন্য বেজায় কাকুতি মিনতি করছে। তারা বলছে,
“দু হাজারই দিতে হবে, এক পয়সাও কমানো যাবে না।”
“ও মা, (হিজড়েদের বলছে মা, লোল...) লক্ষ্মী, আমার অবস্থাটা ভেবে দেখ, আমরা কি এত বড়লোক?”
“ওসব জানি না মাসি, টাকা দেবার সময় সকলেই গরিবি দেখায়। অত ভাবতে গেলে আমাদের পেট চলবে কি করে?”
“মেয়ে তো মা হাসপাতাল থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। সেখানেও তো মা তোমাদের মত ইয়েরা (মানে হিজড়েরা) যাবে, টাকা নেবে, হয়ত নিয়েও গেছে, ডবল করে নিচ্ছ কেন মা?”
“ওসব জানি না মাসি, শ্রীরামপুরের ওরা খেলে কি আমাদের পেট ভরবে?”
আমি এবার কথা না বলে থাকতে পারলাম না,
“মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যে শ্রীরামপুর তা তোমরা জানলে কি করে?”
ওরা আমার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল, তারপর বলল,
“তুমি কে, তোমার সাথে কথা বলছি না।”
“আমি বলছি, আমার কথার উত্তর দাও।”
বৌদি ভয় পেয়ে গেল,
“এই রুমনি চুপ কর না, ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দে মা।”
(আমিও মা, লোল......)
বৌদিকে ভয় পেতে দেখে ওদের চিৎকার আরো বেড়ে গেল। দিতেই হবে, না হলে আমরা খাব কি? তোমরা হাসপাতালে, নার্সিং হোমে, ডাক্তারের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালবে, আর আমাদের দেবার বেলায় টাকা থাকে না। কেন আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আর আজকাল তো একটা বাচ্চা নিয়েই সবাই অপ্রিশন করে নেয়, ওয়ান টু থিরি, দাদা বৌদি ফিরি। তাহলে আমরা যাব কোথায়। ইত্যাদি নানা যুক্তি তারা দেখাতে লাগল।
বৌদি খুব করুণ মুখে দুই হাজার টাকা এনে তাদের হাতে তুলে দিল। অবশ্য আমি খুব বাধা দিয়েছিলাম, বার বার বলেছিলাম এই আপদগুলোকে অত টাকা দিও না, কিন্তু আমার কথা শুনলে তো?
টাকাটা নিয়ে তারা হুকুম দিল,
“একটা কাঁসার থালায় করে কেজিখানেক চাল নিয়ে এসো তো মাসি। আর একটু সরষে আর হলুদও এনো।”
বৌদি তাদের হুকুমমত কাজ করল। তারা সেই চালের থালার উপর দু হাজার টাকার নোটের গোছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র পড়তে লাগল। বৌদি খুব ভক্তিভরে তা দেখতে লাগল। ‘মন্ত্র’ পড়া শেষ হলে নোটের গোছা যথাক্রমে নিজেদের ও বৌদির কপালে ঠেকিয়ে তারা বলল,
“এই চালের থালাটা যত্ন করে ঢাকা দিয়ে রাখবে। নাতি বাড়ি এলে তার মাথায় থালাটা ঠেকাবে, তারপর এই চাল গঙ্গায় ঢেলে দিয়ে আসবে। বুঝেছ?”
এরপর তারা নাচের আয়োজন শুরু করল। একজন কাঁধের ঢোলকটা নামিয়ে চাঁটি দিতে লাগল। বাকী দুই জন নাচের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে গেল। ঢোলক বাজিয়েকে নির্দেশ দিল কোন গানটা ধরতে হবে। আমি বললাম নাচ ফাচ করতে হবে না। তোমরা যাও। বৌদিও আমার কথাকে সমর্থন করে তাদের যেতে বলল। কারণ এই সব হিজড়েদের নাচ প্রায়শই খুব অশ্লীল হয়ে থাকে। কিন্তু তারা না নেচে যাবে না। হয়ত তাদের নাচের মুড এসেছিল, বা দেখাতে চেয়েছিল তারা খুব ভালো নাচে। যাই হোক তারা তাদের জেদ বজায় রাখল, এবং নাচতে শুরু করল। সে কি নাচ। যেন ঝড় তুলে দিল। অতি দ্রুত কোমর নাচানো, এবং অন্যান্য অঙ্গ (কৃত্রিম) নাচানো, তার সঙ্গে ঢোলক বাদ্যি, মাথা একেবারে ধরিয়ে দিল। অবশেষে নাচ টাচ শেষ করে গর্বের সঙ্গে তারা চলে গেল। সেই সঙ্গে আমার মনে অনেক গুলো প্রশ্নকে জাগিয়ে দিয়ে গেল।
প্রশ্ন 1. হিজড়েরা কোথা থেকে আসে? তারা কি হিজড়ে হয়ে জন্মায়?
উত্তরঃ- হিজড়েরা আর সকলের মত মাতৃগর্ভ থেকেই আসে। না, তারা হিজড়ে হয়ে জন্মায় না, জন্মের পরেই হিজড়ে হয়। সকল হিজড়েই জন্মের সময় পুরুষ থাকে, তাই সকল হিজড়েই আসলে পুরুষ। এ দেশে বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় মহল্লায় মহল্লায় আমরা প্রচুর হিজড়ে দেখতে পাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটিও শিশু হিজড়ে দেখি নি (অন্তত আমি দেখি নি)। হাসপাতালে শিশুর জন্মের যে রেজিস্টার থাকে তাতে শিশুটি হয় মেল নয় ফিমেল বলে উল্লেখিত থাকে। শিশুর বাবা মাকে দেওয়া ডিসচার্জ সার্টিফিকেটেও শিশুর সেক্স মেল, অথবা ফিমেল থাকে, কিন্তু হিজড়ে বলে কোন অপশন থাকে না। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রকৃতি হয় স্ত্রী, নয়তো পুরুষই সৃষ্টি করে, এখানে কোন হিজড়ের স্থান নেই (আমার মতের সপক্ষে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার হাতে নেই, কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত)। হিজড়ে বানানো হয় জন্মের পরে। ভারতে অনেক ‘হাসপাতাল’ আছে যেখানে হিজড়ে বানানো হয়, লিঙ্গচ্ছেদন করে। কিন্তু এডাল্ট পুরুষদেরই বানানো হয়, তাদের সম্মতি নিয়ে। শিশুদের সাথে এটা করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। সে জন্যই কোন শিশু হিজড়ে আমরা দেখতে পাই না।
প্রশ্ন 2. কেন তাদের হিজড়ে বানানো হয়? বা কেন তারা হিজড়ে হয়?
উত্তরঃ- কারণ তারা হিজড়াবৃত্তিকে পেশা হিসাবে নিতে চায়, এটা খুবই লাভজনক। কারণ এই পেশায় কোন শ্রম বা বিশেষ দক্ষতা দরকার হয় না শুধু একটু কোমর নাচাতে পারলেই হল। তার জন্য তাদের যেটা করতে হয়, সেটা হল নিজের পুরুষাঙ্গটা কেটে বাদ দেওয়া। শুধু পুরুষাঙ্গ কেটে বাদ দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, কারণ পুরুষের পুরুষত্ব তার একটি অঙ্গেই থাকে না, তার পুরুষত্বের চিহ্ন তার সর্বাঙ্গেই ছড়িয়ে থাকে, তাই তাকে প্রতিনিয়ত হিজড়ে বনে থাকতে হয়, অর্থাৎ, গায়ের লোম তোলার জন্য নিয়মিত ওয়াক্সিং করতে হয়, নিয়মিত ময়শ্চারাইজার মাখতে হয় (যা তার ত্বককে কোমল রাখবে, যাতে করে তাকে পুরুষ না মনে হয়), ও দাড়ি গোঁফকে বিশেষ ভাবে নির্মূল করতে হয়। তাকে হিজড়ে সেজে থাকার জন্য নিয়মিত প্রচুর প্রসাধন করতে হয়। এই সব করে সে লোকের বাড়ি বাড়ি বাচ্চা হলেই গিয়ে ‘নাচগান’ করে ও টাকার জন্য উৎপাত করে, এইভাবে মোটা টাকা রোজগার করে, এটাই তাদের পেশা। কখনও কখনও ট্রেনের কামরাতেও তাদের উৎপাত করতে দেখা যায়। অনেকে আবার যৌন কর্মও করে, অর্থাৎ নিজের পুরুষত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে অন্য পুরুষদের মনোরঞ্জন করে। বাংলার বাইরে অন্যান্য রাজ্যে হিজড়েরা বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানেও নাচাগানা করে।
দিনে দিনে তাদের অবস্থার প্রচুর উন্নতি হচ্ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখনও হিজড়েদের দেখতাম। কমদামি রংচঙে শাড়ী, সস্তার চপ্পল পরে তারা বাড়ি বাড়ি নাচতে আসত। মেক আপের তো প্রশ্নই ছিল না। গরীব লোকেদের মতই চেহারা ছিল তাদের, এবং বলাই বাহুল্য অনেকটাই পুরুষসুলভ চেহারা ছিল। চুল ছোট করে কাটলে এবং প্যান্ট শার্ট পরলে কে বলবে পুরুষ নয়। কিন্তু এখন আর সে কথা বলা যায় না। তারা অনেক বেশী নমনীয় ও কমনীয় থাকার কৌশল আয়ত্ত্ব করেছে এবং সেই মত আর্থিক সামর্থ্যও ‘অর্জন’ করেছে। এখন তাদের পরনে দামী শাড়ী দামী গয়না, দামী হ্যান্ডব্যাগ, দামী মোবাইল, তারা রিকসা ছাড়া চলে না। এ সবই চলছে নির্বোধ সাধারন মানুষের কষ্টার্জিত আয়ে থাবা বসিয়ে।
প্রশ্ন 3. হিজড়েরা কি ভাবে জানতে পারে কোথায় কোন এলাকায় কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে?
উত্তরঃ- আমি সর্বদাই দেখেছি হিজড়েরা কোনও বাড়িতে বাচ্চা হলেই ঠিক সেখানে পৌঁছে যায় ও আশপাশের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে এখানে কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে। কিভাবে তারা এটা পারে। দেখা যায়, হাসপাতাল বা নার্সিং হোম থেকে মা বাচ্চা নিয়ে বাড়ি আসার দু একদিনের মধ্যেই হিজড়েরা চলে আসে, এর কোন হেরফের হয় না। যদি নর্মাল ডেলিভারি হয় তাহলে মা সাধারণত দু তিনদিনের মধ্যেই বাড়ি চলে আসে, যদি সিজারিয়ান হয় তাহলে সাতদিন পর, যদি অন্য কোন জটিলতা দেখা যায় তাহলে আরো দেরী হতে পারে। কিন্তু যখনই আসুক, হিজড়েরা মা বাড়ি আসার ঠিক দু একদিনের মধ্যেই চলে আসে। এত নিখুঁত টাইমিংই বা হয় কি করে? কারণ আর কিছুই নয়, সমস্ত ঠিকানা এবং ডিটেলস তারা হাসপাতাল কর্মীদের থেকেই পেয়ে যায়, অবশ্যই মোটা টাকার বিনিময়ে। যে সব কর্মীরা (ঠিক কোন শ্রেণীর কর্মীরা এটা করে জানি না, কারণ এইসব তথ্য সরবরাহের কাজটা নিশ্চয়ই খুব গোপনে হয়, এবং জিজ্ঞেস করতে গেলে সকলেই অস্বীকার করবে) তাদের নাম ঠিকানা ইত্যাদি সরবরাহ করে, পেশেন্ট মরে গেলেও তারা কিন্তু ফিরেও তাকায় না। আমি অনেক সময় দেখেছি অসুস্থ রোগী ‘জল জল’ করছে, চিৎকার করার শক্তিও তার নেই, অথচ তাকে জল দেবার যার ডিউটি তার পাত্তা নেই। এই সব ‘কর্মীরা’ কিন্তু পেশেন্টের বিষয়ে একেবারে উদাসীন নয়। বিশেষ করে যারা বাচ্চা হতে আসে। আপাত উদাসীনতার আড়ালে তার নাম ঠিকানা (বাপের বাড়ির ও শ্বশুর বাড়ির) যত্ন করে টুকে রাখে। এবং হিজড়েদের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেয়। শুধু নাম ঠিকানাই নয়, কাকে কবে কখন রিলিজ করা হল সেটাও, কারণ বেটাইমে গেলে তো হিজড়েদের পরিশ্রমটাই বিফল।
আর একটি গুরুত্বপুর্ণ তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। ন্যাট জিও চ্যানেলে হিজড়েদের বিষয়ে একটি প্রোগ্রামে দেখেছিলাম, যত হিজড়ে আছে, সবাই কিন্তু লিঙ্গচ্ছেদন করে না। তারা বাইরে হিজড়ে সেজে থাকলেও ভিতরে ভিতরে আদ্যন্ত পুরুষ। টাকা রোজগারের জন্য কতই না কুকাজ পুরুষরা করতে পারে।
তারা তাদের ‘অধিকার’ রক্ষার জন্য আন্দোলনও করে থাকে। মিডিয়া তাদের পক্ষে, আরও অনেক ‘সংগঠন’ তাদের পক্ষে, তাদের নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে অনেক সিনেমা, নাটক বানানো হয়েছে। সম্প্রতি তাদের আন্দোলনের চাপে পড়ে আমাদের মেরুদন্ডহীন বর্তমান সরকার হিজড়েদেরও স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে তারা তাদের যে কোনও পরিচয়পত্রে সেক্স হিজড়ে লিখতে পারবে। এতদিন তারা মেল বা পুরুষ বলে উল্লেখিত হত। সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।
“দু হাজারই দিতে হবে, এক পয়সাও কমানো যাবে না।”
“ও মা, (হিজড়েদের বলছে মা, লোল...) লক্ষ্মী, আমার অবস্থাটা ভেবে দেখ, আমরা কি এত বড়লোক?”
“ওসব জানি না মাসি, টাকা দেবার সময় সকলেই গরিবি দেখায়। অত ভাবতে গেলে আমাদের পেট চলবে কি করে?”
“মেয়ে তো মা হাসপাতাল থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। সেখানেও তো মা তোমাদের মত ইয়েরা (মানে হিজড়েরা) যাবে, টাকা নেবে, হয়ত নিয়েও গেছে, ডবল করে নিচ্ছ কেন মা?”
“ওসব জানি না মাসি, শ্রীরামপুরের ওরা খেলে কি আমাদের পেট ভরবে?”
আমি এবার কথা না বলে থাকতে পারলাম না,
“মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যে শ্রীরামপুর তা তোমরা জানলে কি করে?”
ওরা আমার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল, তারপর বলল,
“তুমি কে, তোমার সাথে কথা বলছি না।”
“আমি বলছি, আমার কথার উত্তর দাও।”
বৌদি ভয় পেয়ে গেল,
“এই রুমনি চুপ কর না, ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দে মা।”
(আমিও মা, লোল......)
বৌদিকে ভয় পেতে দেখে ওদের চিৎকার আরো বেড়ে গেল। দিতেই হবে, না হলে আমরা খাব কি? তোমরা হাসপাতালে, নার্সিং হোমে, ডাক্তারের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালবে, আর আমাদের দেবার বেলায় টাকা থাকে না। কেন আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আর আজকাল তো একটা বাচ্চা নিয়েই সবাই অপ্রিশন করে নেয়, ওয়ান টু থিরি, দাদা বৌদি ফিরি। তাহলে আমরা যাব কোথায়। ইত্যাদি নানা যুক্তি তারা দেখাতে লাগল।
বৌদি খুব করুণ মুখে দুই হাজার টাকা এনে তাদের হাতে তুলে দিল। অবশ্য আমি খুব বাধা দিয়েছিলাম, বার বার বলেছিলাম এই আপদগুলোকে অত টাকা দিও না, কিন্তু আমার কথা শুনলে তো?
টাকাটা নিয়ে তারা হুকুম দিল,
“একটা কাঁসার থালায় করে কেজিখানেক চাল নিয়ে এসো তো মাসি। আর একটু সরষে আর হলুদও এনো।”
বৌদি তাদের হুকুমমত কাজ করল। তারা সেই চালের থালার উপর দু হাজার টাকার নোটের গোছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র পড়তে লাগল। বৌদি খুব ভক্তিভরে তা দেখতে লাগল। ‘মন্ত্র’ পড়া শেষ হলে নোটের গোছা যথাক্রমে নিজেদের ও বৌদির কপালে ঠেকিয়ে তারা বলল,
“এই চালের থালাটা যত্ন করে ঢাকা দিয়ে রাখবে। নাতি বাড়ি এলে তার মাথায় থালাটা ঠেকাবে, তারপর এই চাল গঙ্গায় ঢেলে দিয়ে আসবে। বুঝেছ?”
এরপর তারা নাচের আয়োজন শুরু করল। একজন কাঁধের ঢোলকটা নামিয়ে চাঁটি দিতে লাগল। বাকী দুই জন নাচের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে গেল। ঢোলক বাজিয়েকে নির্দেশ দিল কোন গানটা ধরতে হবে। আমি বললাম নাচ ফাচ করতে হবে না। তোমরা যাও। বৌদিও আমার কথাকে সমর্থন করে তাদের যেতে বলল। কারণ এই সব হিজড়েদের নাচ প্রায়শই খুব অশ্লীল হয়ে থাকে। কিন্তু তারা না নেচে যাবে না। হয়ত তাদের নাচের মুড এসেছিল, বা দেখাতে চেয়েছিল তারা খুব ভালো নাচে। যাই হোক তারা তাদের জেদ বজায় রাখল, এবং নাচতে শুরু করল। সে কি নাচ। যেন ঝড় তুলে দিল। অতি দ্রুত কোমর নাচানো, এবং অন্যান্য অঙ্গ (কৃত্রিম) নাচানো, তার সঙ্গে ঢোলক বাদ্যি, মাথা একেবারে ধরিয়ে দিল। অবশেষে নাচ টাচ শেষ করে গর্বের সঙ্গে তারা চলে গেল। সেই সঙ্গে আমার মনে অনেক গুলো প্রশ্নকে জাগিয়ে দিয়ে গেল।
প্রশ্ন 1. হিজড়েরা কোথা থেকে আসে? তারা কি হিজড়ে হয়ে জন্মায়?
উত্তরঃ- হিজড়েরা আর সকলের মত মাতৃগর্ভ থেকেই আসে। না, তারা হিজড়ে হয়ে জন্মায় না, জন্মের পরেই হিজড়ে হয়। সকল হিজড়েই জন্মের সময় পুরুষ থাকে, তাই সকল হিজড়েই আসলে পুরুষ। এ দেশে বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় মহল্লায় মহল্লায় আমরা প্রচুর হিজড়ে দেখতে পাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত একটিও শিশু হিজড়ে দেখি নি (অন্তত আমি দেখি নি)। হাসপাতালে শিশুর জন্মের যে রেজিস্টার থাকে তাতে শিশুটি হয় মেল নয় ফিমেল বলে উল্লেখিত থাকে। শিশুর বাবা মাকে দেওয়া ডিসচার্জ সার্টিফিকেটেও শিশুর সেক্স মেল, অথবা ফিমেল থাকে, কিন্তু হিজড়ে বলে কোন অপশন থাকে না। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রকৃতি হয় স্ত্রী, নয়তো পুরুষই সৃষ্টি করে, এখানে কোন হিজড়ের স্থান নেই (আমার মতের সপক্ষে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার হাতে নেই, কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত)। হিজড়ে বানানো হয় জন্মের পরে। ভারতে অনেক ‘হাসপাতাল’ আছে যেখানে হিজড়ে বানানো হয়, লিঙ্গচ্ছেদন করে। কিন্তু এডাল্ট পুরুষদেরই বানানো হয়, তাদের সম্মতি নিয়ে। শিশুদের সাথে এটা করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। সে জন্যই কোন শিশু হিজড়ে আমরা দেখতে পাই না।
প্রশ্ন 2. কেন তাদের হিজড়ে বানানো হয়? বা কেন তারা হিজড়ে হয়?
উত্তরঃ- কারণ তারা হিজড়াবৃত্তিকে পেশা হিসাবে নিতে চায়, এটা খুবই লাভজনক। কারণ এই পেশায় কোন শ্রম বা বিশেষ দক্ষতা দরকার হয় না শুধু একটু কোমর নাচাতে পারলেই হল। তার জন্য তাদের যেটা করতে হয়, সেটা হল নিজের পুরুষাঙ্গটা কেটে বাদ দেওয়া। শুধু পুরুষাঙ্গ কেটে বাদ দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, কারণ পুরুষের পুরুষত্ব তার একটি অঙ্গেই থাকে না, তার পুরুষত্বের চিহ্ন তার সর্বাঙ্গেই ছড়িয়ে থাকে, তাই তাকে প্রতিনিয়ত হিজড়ে বনে থাকতে হয়, অর্থাৎ, গায়ের লোম তোলার জন্য নিয়মিত ওয়াক্সিং করতে হয়, নিয়মিত ময়শ্চারাইজার মাখতে হয় (যা তার ত্বককে কোমল রাখবে, যাতে করে তাকে পুরুষ না মনে হয়), ও দাড়ি গোঁফকে বিশেষ ভাবে নির্মূল করতে হয়। তাকে হিজড়ে সেজে থাকার জন্য নিয়মিত প্রচুর প্রসাধন করতে হয়। এই সব করে সে লোকের বাড়ি বাড়ি বাচ্চা হলেই গিয়ে ‘নাচগান’ করে ও টাকার জন্য উৎপাত করে, এইভাবে মোটা টাকা রোজগার করে, এটাই তাদের পেশা। কখনও কখনও ট্রেনের কামরাতেও তাদের উৎপাত করতে দেখা যায়। অনেকে আবার যৌন কর্মও করে, অর্থাৎ নিজের পুরুষত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে অন্য পুরুষদের মনোরঞ্জন করে। বাংলার বাইরে অন্যান্য রাজ্যে হিজড়েরা বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানেও নাচাগানা করে।
দিনে দিনে তাদের অবস্থার প্রচুর উন্নতি হচ্ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখনও হিজড়েদের দেখতাম। কমদামি রংচঙে শাড়ী, সস্তার চপ্পল পরে তারা বাড়ি বাড়ি নাচতে আসত। মেক আপের তো প্রশ্নই ছিল না। গরীব লোকেদের মতই চেহারা ছিল তাদের, এবং বলাই বাহুল্য অনেকটাই পুরুষসুলভ চেহারা ছিল। চুল ছোট করে কাটলে এবং প্যান্ট শার্ট পরলে কে বলবে পুরুষ নয়। কিন্তু এখন আর সে কথা বলা যায় না। তারা অনেক বেশী নমনীয় ও কমনীয় থাকার কৌশল আয়ত্ত্ব করেছে এবং সেই মত আর্থিক সামর্থ্যও ‘অর্জন’ করেছে। এখন তাদের পরনে দামী শাড়ী দামী গয়না, দামী হ্যান্ডব্যাগ, দামী মোবাইল, তারা রিকসা ছাড়া চলে না। এ সবই চলছে নির্বোধ সাধারন মানুষের কষ্টার্জিত আয়ে থাবা বসিয়ে।
প্রশ্ন 3. হিজড়েরা কি ভাবে জানতে পারে কোথায় কোন এলাকায় কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে?
উত্তরঃ- আমি সর্বদাই দেখেছি হিজড়েরা কোনও বাড়িতে বাচ্চা হলেই ঠিক সেখানে পৌঁছে যায় ও আশপাশের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে এখানে কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে। কিভাবে তারা এটা পারে। দেখা যায়, হাসপাতাল বা নার্সিং হোম থেকে মা বাচ্চা নিয়ে বাড়ি আসার দু একদিনের মধ্যেই হিজড়েরা চলে আসে, এর কোন হেরফের হয় না। যদি নর্মাল ডেলিভারি হয় তাহলে মা সাধারণত দু তিনদিনের মধ্যেই বাড়ি চলে আসে, যদি সিজারিয়ান হয় তাহলে সাতদিন পর, যদি অন্য কোন জটিলতা দেখা যায় তাহলে আরো দেরী হতে পারে। কিন্তু যখনই আসুক, হিজড়েরা মা বাড়ি আসার ঠিক দু একদিনের মধ্যেই চলে আসে। এত নিখুঁত টাইমিংই বা হয় কি করে? কারণ আর কিছুই নয়, সমস্ত ঠিকানা এবং ডিটেলস তারা হাসপাতাল কর্মীদের থেকেই পেয়ে যায়, অবশ্যই মোটা টাকার বিনিময়ে। যে সব কর্মীরা (ঠিক কোন শ্রেণীর কর্মীরা এটা করে জানি না, কারণ এইসব তথ্য সরবরাহের কাজটা নিশ্চয়ই খুব গোপনে হয়, এবং জিজ্ঞেস করতে গেলে সকলেই অস্বীকার করবে) তাদের নাম ঠিকানা ইত্যাদি সরবরাহ করে, পেশেন্ট মরে গেলেও তারা কিন্তু ফিরেও তাকায় না। আমি অনেক সময় দেখেছি অসুস্থ রোগী ‘জল জল’ করছে, চিৎকার করার শক্তিও তার নেই, অথচ তাকে জল দেবার যার ডিউটি তার পাত্তা নেই। এই সব ‘কর্মীরা’ কিন্তু পেশেন্টের বিষয়ে একেবারে উদাসীন নয়। বিশেষ করে যারা বাচ্চা হতে আসে। আপাত উদাসীনতার আড়ালে তার নাম ঠিকানা (বাপের বাড়ির ও শ্বশুর বাড়ির) যত্ন করে টুকে রাখে। এবং হিজড়েদের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেয়। শুধু নাম ঠিকানাই নয়, কাকে কবে কখন রিলিজ করা হল সেটাও, কারণ বেটাইমে গেলে তো হিজড়েদের পরিশ্রমটাই বিফল।
আর একটি গুরুত্বপুর্ণ তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। ন্যাট জিও চ্যানেলে হিজড়েদের বিষয়ে একটি প্রোগ্রামে দেখেছিলাম, যত হিজড়ে আছে, সবাই কিন্তু লিঙ্গচ্ছেদন করে না। তারা বাইরে হিজড়ে সেজে থাকলেও ভিতরে ভিতরে আদ্যন্ত পুরুষ। টাকা রোজগারের জন্য কতই না কুকাজ পুরুষরা করতে পারে।
তারা তাদের ‘অধিকার’ রক্ষার জন্য আন্দোলনও করে থাকে। মিডিয়া তাদের পক্ষে, আরও অনেক ‘সংগঠন’ তাদের পক্ষে, তাদের নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে অনেক সিনেমা, নাটক বানানো হয়েছে। সম্প্রতি তাদের আন্দোলনের চাপে পড়ে আমাদের মেরুদন্ডহীন বর্তমান সরকার হিজড়েদেরও স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে তারা তাদের যে কোনও পরিচয়পত্রে সেক্স হিজড়ে লিখতে পারবে। এতদিন তারা মেল বা পুরুষ বলে উল্লেখিত হত। সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।
সৌজন্যে @ "http://roomnee.blogspot.in/2012/11/blog-post.html"