Monday, August 17, 2015

থার্ড জেন্ডার অফ ইন্ডিয়া

কিছুদিন আগে আমি বিশেষ প্রয়োজনে আমার পরিচিত একজনের বাড়ি গেছিলাম। ভদ্রমহিলাকে আমি বৌদি বলে ডাকি। তাঁর মেয়ের বছরখানেক হল বিয়ে হয়েছে এবং (আমি যেদিন গেছিলাম তার) আট দশ দিন আগে বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চা হবার আগে সে বাপের বাড়ি আসে, তারপর স্থানীয় একটি হাসপাতালে তার বাচ্চা হয়, সিজারিয়ান অপারেশন করে, তার পর সে হাসপাতাল থেকে শ্রীরামপুরে তার শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। তার বাড়ি গিয়ে দেখি, তিনজন হিজড়ে এসে উপস্থিত। খুব জমকালো সাজসজ্জা করে এসেছে। চকমকে শাড়ি, মেকআপ, লিপস্টিক, আই লাইনার, কোনকিছুর ত্রুটি নেই, একজনের কাঁধে দড়িতে বাঁধা ঢোলক।  তারা  বৌদির কাছ থেকে মেয়ের বাচ্চা হবার জন্য দুই হাজার টাকা দাবী করছে। বৌদি টাকার পরিমান কমানোর জন্য বেজায় কাকুতি মিনতি করছে। তারা বলছে,
“দু হাজারই দিতে হবে, এক পয়সাও কমানো যাবে না।”
“ও মা, (হিজড়েদের বলছে মা, লোল...) লক্ষ্মী, আমার অবস্থাটা ভেবে দেখ, আমরা কি এত বড়লোক?”
“ওসব জানি না মাসি, টাকা দেবার সময় সকলেই গরিবি দেখায়। অত ভাবতে গেলে আমাদের পেট চলবে কি করে?”
“মেয়ে তো মা হাসপাতাল থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। সেখানেও তো মা তোমাদের মত ইয়েরা (মানে হিজড়েরা) যাবে, টাকা নেবে, হয়ত নিয়েও গেছে, ডবল করে নিচ্ছ কেন মা?”
“ওসব জানি না মাসি, শ্রীরামপুরের ওরা খেলে কি আমাদের পেট ভরবে?”
আমি এবার কথা না বলে থাকতে পারলাম না,
“মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যে শ্রীরামপুর তা তোমরা জানলে কি করে?”
ওরা আমার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল, তারপর বলল,
“তুমি কে, তোমার সাথে কথা বলছি না।”
“আমি বলছি, আমার কথার উত্তর দাও।”
বৌদি ভয় পেয়ে গেল,
“এই রুমনি  চুপ কর না, ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দে মা।”
(আমিও মা, লোল......)
বৌদিকে ভয় পেতে দেখে ওদের চিৎকার আরো বেড়ে গেল। দিতেই হবে, না হলে আমরা খাব কি? তোমরা হাসপাতালে, নার্সিং হোমে, ডাক্তারের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালবে, আর আমাদের দেবার বেলায় টাকা থাকে না। কেন আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আর আজকাল তো একটা বাচ্চা নিয়েই সবাই অপ্রিশন করে নেয়, ওয়ান টু থিরি, দাদা বৌদি ফিরি। তাহলে আমরা যাব কোথায়। ইত্যাদি নানা যুক্তি তারা দেখাতে লাগল।
বৌদি খুব করুণ মুখে দুই হাজার টাকা এনে তাদের হাতে তুলে দিল। অবশ্য আমি খুব বাধা দিয়েছিলাম, বার বার বলেছিলাম এই আপদগুলোকে অত টাকা  দিও না, কিন্তু আমার কথা শুনলে তো?
টাকাটা নিয়ে তারা হুকুম দিল,
“একটা কাঁসার থালায় করে কেজিখানেক চাল নিয়ে এসো তো মাসি। আর একটু সরষে আর হলুদও এনো।”
বৌদি   তাদের হুকুমমত কাজ করল। তারা সেই চালের থালার উপর দু হাজার টাকার নোটের গোছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিড় বিড় করে কি সব মন্ত্র পড়তে লাগল। বৌদি খুব ভক্তিভরে তা দেখতে লাগল। ‘মন্ত্র’ পড়া শেষ হলে নোটের গোছা যথাক্রমে নিজেদের ও বৌদির কপালে ঠেকিয়ে তারা বলল,
“এই চালের থালাটা যত্ন করে ঢাকা দিয়ে রাখবে। নাতি বাড়ি এলে তার মাথায় থালাটা ঠেকাবে, তারপর এই চাল গঙ্গায় ঢেলে দিয়ে আসবে। বুঝেছ?”
এরপর তারা নাচের আয়োজন শুরু করল। একজন কাঁধের ঢোলকটা নামিয়ে চাঁটি দিতে লাগল। বাকী দুই জন নাচের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে গেল। ঢোলক বাজিয়েকে নির্দেশ দিল কোন গানটা ধরতে হবে। আমি বললাম নাচ ফাচ করতে হবে না। তোমরা যাও। বৌদিও আমার কথাকে সমর্থন করে তাদের যেতে বলল। কারণ এই সব হিজড়েদের নাচ প্রায়শই খুব অশ্লীল হয়ে থাকে। কিন্তু তারা না নেচে যাবে না। হয়ত তাদের নাচের মুড এসেছিল, বা দেখাতে চেয়েছিল তারা খুব ভালো নাচে। যাই হোক তারা তাদের জেদ বজায় রাখল, এবং নাচতে শুরু করল। সে কি নাচ। যেন ঝড় তুলে দিল। অতি দ্রুত কোমর নাচানো, এবং অন্যান্য অঙ্গ (কৃত্রিম) নাচানো, তার সঙ্গে ঢোলক বাদ্যি, মাথা একেবারে ধরিয়ে  দিল। অবশেষে নাচ টাচ শেষ করে গর্বের সঙ্গে তারা চলে গেল। সেই সঙ্গে আমার মনে অনেক গুলো প্রশ্নকে জাগিয়ে দিয়ে গেল।
প্রশ্ন 1. হিজড়েরা কোথা থেকে আসে? তারা কি হিজড়ে হয়ে জন্মায়?
উত্তরঃ- হিজড়েরা আর সকলের মত মাতৃগর্ভ থেকেই আসে। না, তারা হিজড়ে হয়ে জন্মায় না, জন্মের পরেই হিজড়ে হয়। সকল হিজড়েই জন্মের সময় পুরুষ থাকে, তাই সকল হিজড়েই আসলে পুরুষ। এ দেশে বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় মহল্লায় মহল্লায় আমরা প্রচুর হিজড়ে দেখতে পাই, কিন্তু  আজ পর্যন্ত একটিও শিশু হিজড়ে দেখি নি (অন্তত আমি দেখি নি)। হাসপাতালে শিশুর জন্মের যে রেজিস্টার থাকে তাতে শিশুটি হয় মেল নয় ফিমেল বলে উল্লেখিত থাকে। শিশুর  বাবা মাকে দেওয়া ডিসচার্জ সার্টিফিকেটেও শিশুর সেক্স মেল, অথবা ফিমেল থাকে, কিন্তু হিজড়ে বলে কোন অপশন থাকে না। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রকৃতি হয় স্ত্রী, নয়তো পুরুষই সৃষ্টি করে, এখানে কোন হিজড়ের স্থান নেই (আমার মতের সপক্ষে কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমার হাতে নেই, কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত)।  হিজড়ে বানানো হয় জন্মের পরে। ভারতে অনেক ‘হাসপাতাল’ আছে  যেখানে হিজড়ে বানানো হয়, লিঙ্গচ্ছেদন করে। কিন্তু এডাল্ট পুরুষদেরই বানানো হয়, তাদের সম্মতি নিয়ে।  শিশুদের সাথে এটা করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। সে জন্যই কোন শিশু হিজড়ে আমরা দেখতে পাই না।
প্রশ্ন 2. কেন তাদের হিজড়ে বানানো হয়? বা কেন তারা হিজড়ে হয়?
উত্তরঃ-  কারণ তারা হিজড়াবৃত্তিকে পেশা হিসাবে নিতে চায়, এটা খুবই লাভজনক। কারণ এই পেশায় কোন শ্রম বা বিশেষ দক্ষতা দরকার হয় না শুধু একটু কোমর নাচাতে পারলেই হল। তার জন্য তাদের যেটা করতে হয়, সেটা হল নিজের পুরুষাঙ্গটা কেটে বাদ দেওয়া। শুধু পুরুষাঙ্গ কেটে বাদ দিলেই কাজ শেষ হয়ে যায় না, কারণ পুরুষের পুরুষত্ব তার একটি অঙ্গেই থাকে না, তার পুরুষত্বের চিহ্ন তার সর্বাঙ্গেই ছড়িয়ে থাকে, তাই তাকে প্রতিনিয়ত হিজড়ে বনে থাকতে হয়, অর্থাৎ, গায়ের লোম তোলার জন্য নিয়মিত ওয়াক্সিং করতে হয়, নিয়মিত ময়শ্চারাইজার মাখতে হয় (যা তার ত্বককে কোমল রাখবে, যাতে করে তাকে পুরুষ না মনে হয়), ও দাড়ি গোঁফকে বিশেষ ভাবে নির্মূল করতে হয়। তাকে হিজড়ে সেজে থাকার জন্য নিয়মিত প্রচুর প্রসাধন করতে হয়। এই সব করে সে লোকের বাড়ি বাড়ি বাচ্চা হলেই গিয়ে ‘নাচগান’ করে ও টাকার জন্য উৎপাত করে, এইভাবে মোটা টাকা রোজগার করে, এটাই তাদের পেশা। কখনও কখনও ট্রেনের কামরাতেও তাদের উৎপাত করতে দেখা যায়। অনেকে আবার যৌন কর্মও করে, অর্থাৎ নিজের পুরুষত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে অন্য পুরুষদের মনোরঞ্জন করে। বাংলার বাইরে অন্যান্য রাজ্যে হিজড়েরা বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠানেও নাচাগানা করে।
দিনে দিনে তাদের অবস্থার প্রচুর উন্নতি হচ্ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখনও হিজড়েদের দেখতাম। কমদামি রংচঙে শাড়ী, সস্তার চপ্পল পরে তারা বাড়ি বাড়ি নাচতে আসত। মেক আপের তো প্রশ্নই ছিল না। গরীব লোকেদের মতই চেহারা ছিল তাদের, এবং বলাই বাহুল্য অনেকটাই পুরুষসুলভ চেহারা ছিল। চুল ছোট করে কাটলে এবং প্যান্ট শার্ট পরলে কে বলবে পুরুষ নয়। কিন্তু এখন আর সে কথা বলা যায় না। তারা অনেক বেশী নমনীয় ও কমনীয় থাকার কৌশল আয়ত্ত্ব করেছে এবং সেই মত আর্থিক সামর্থ্যও ‘অর্জন’ করেছে। এখন তাদের পরনে দামী শাড়ী দামী গয়না, দামী হ্যান্ডব্যাগ, দামী মোবাইল, তারা রিকসা ছাড়া চলে না। এ সবই চলছে নির্বোধ সাধারন মানুষের কষ্টার্জিত আয়ে থাবা বসিয়ে।
প্রশ্ন 3. হিজড়েরা কি ভাবে জানতে পারে কোথায় কোন এলাকায় কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে?
উত্তরঃ- আমি সর্বদাই দেখেছি হিজড়েরা কোনও বাড়িতে বাচ্চা হলেই ঠিক সেখানে পৌঁছে যায় ও আশপাশের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে এখানে কোন বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে। কিভাবে তারা এটা পারে। দেখা যায়, হাসপাতাল বা নার্সিং হোম থেকে মা বাচ্চা নিয়ে বাড়ি আসার দু একদিনের মধ্যেই হিজড়েরা চলে আসে, এর কোন হেরফের হয় না। যদি নর্মাল ডেলিভারি হয় তাহলে মা সাধারণত দু  তিনদিনের মধ্যেই বাড়ি চলে আসে, যদি সিজারিয়ান হয় তাহলে সাতদিন পর, যদি অন্য কোন জটিলতা দেখা যায় তাহলে আরো দেরী হতে পারে। কিন্তু যখনই আসুক, হিজড়েরা মা বাড়ি আসার ঠিক দু একদিনের মধ্যেই চলে আসে। এত নিখুঁত টাইমিংই বা হয় কি করে?  কারণ আর কিছুই নয়, সমস্ত ঠিকানা এবং ডিটেলস তারা হাসপাতাল কর্মীদের থেকেই পেয়ে যায়, অবশ্যই মোটা টাকার বিনিময়ে। যে সব কর্মীরা (ঠিক কোন শ্রেণীর কর্মীরা এটা করে জানি না, কারণ এইসব তথ্য সরবরাহের কাজটা নিশ্চয়ই খুব গোপনে হয়, এবং জিজ্ঞেস করতে গেলে সকলেই অস্বীকার করবে) তাদের নাম ঠিকানা ইত্যাদি সরবরাহ করে, পেশেন্ট মরে গেলেও তারা কিন্তু ফিরেও তাকায় না। আমি অনেক সময় দেখেছি অসুস্থ রোগী ‘জল জল’ করছে, চিৎকার করার শক্তিও তার নেই, অথচ তাকে জল দেবার যার ডিউটি তার পাত্তা নেই। এই সব ‘কর্মীরা’ কিন্তু পেশেন্টের বিষয়ে একেবারে উদাসীন নয়। বিশেষ করে যারা বাচ্চা হতে আসে। আপাত উদাসীনতার আড়ালে তার নাম ঠিকানা (বাপের বাড়ির ও শ্বশুর বাড়ির) যত্ন করে টুকে রাখে। এবং হিজড়েদের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেয়। শুধু নাম ঠিকানাই নয়, কাকে কবে কখন রিলিজ করা হল সেটাও,  কারণ বেটাইমে গেলে তো হিজড়েদের পরিশ্রমটাই বিফল।
আর একটি গুরুত্বপুর্ণ তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি।  ন্যাট জিও চ্যানেলে হিজড়েদের বিষয়ে একটি প্রোগ্রামে দেখেছিলাম, যত হিজড়ে আছে, সবাই কিন্তু লিঙ্গচ্ছেদন করে না। তারা বাইরে হিজড়ে সেজে থাকলেও ভিতরে ভিতরে আদ্যন্ত পুরুষ। টাকা রোজগারের জন্য কতই না কুকাজ পুরুষরা করতে পারে।
তারা তাদের ‘অধিকার’ রক্ষার জন্য আন্দোলনও করে থাকে। মিডিয়া তাদের পক্ষে, আরও অনেক ‘সংগঠন’ তাদের পক্ষে, তাদের নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে অনেক সিনেমা, নাটক বানানো হয়েছে। সম্প্রতি তাদের আন্দোলনের চাপে পড়ে আমাদের মেরুদন্ডহীন বর্তমান সরকার হিজড়েদেরও স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ এখন থেকে  তারা তাদের যে কোনও পরিচয়পত্রে সেক্স হিজড়ে লিখতে পারবে। এতদিন তারা মেল বা পুরুষ বলে উল্লেখিত হত। সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।

সৌজন্যে @ "http://roomnee.blogspot.in/2012/11/blog-post.html"

পুংলিঙ্গ কেটে বানানো হচ্ছে হিজড়া।

আমরা যাদের হিজড়া বলে জানি বা চিনি তারা কি আসলেই হিজড়া? দেহাকৃতি হিজড়ার মতো হলেও তাদের অধিকাংশই এক সময় সাধারণ মানুষ ছিল। কিন্তু লিঙ্গ কর্তনের মধ্য দিয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়।
রাজধানীর শ্যামলী, ঢাকা জেলাধীন ধামরাই ও খুলনার ফুলতলায় কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিকে পেশাদার ও ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের দিয়েই পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরি করা হয়। এসব ক্লিনিক যেন এক একটি হিজড়া তৈরির কারখানা। হিজড়া নামের আড়ালে লিঙ্গ কর্তন করা হাজার হাজার পুরুষ ঢাকাসহ সারাদেশে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন-খারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চাঁদাবাজির টাকায় গড়ে তুলেছে বাড়ি-গাড়ি। অঢেল সম্পদ। ঢাকায় বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এই হিজড়ারা নিয়োগ দিয়ে রেখেছে নিজস্ব সোর্স। ওই সোর্সের মাধ্যমেই কোনো নবজাতক জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তারা খবর পেয়ে যায়। আর সে তথ্যের ভিত্তিতে বেঁধে দেয় চাঁদার পরিমাণ। তারা দলবদ্ধভাবে নবজাতকের পরিবারের উপর হামলে পড়ে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোন চক্রের খপ্পরে পড়ে বা স্বেচ্ছায় লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের সঙ্গে অপরাধীদেরও যোগসাজশ রয়েছে। হিজড়া পরিবারের কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার এলাকার লোকজনও তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। ফলে এরা একবার যখন বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, তখন আর ফেরার উপায় থাকে না। এ কারণে বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে মিশে যে কোন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পতিতাবৃত্তির সঙ্গেও তাদের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে। লিঙ্গ কাটা হিজড়াদের তাণ্ডবে জন্মগতভাবে পৃথিবীতে আসা হিজড়ারাও কখনওবা অসহায় হয়ে পড়ে। সরকারের বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনীও তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার হিজড়াদের অসহায় জীবন নিয়ে তারা নিজেরাও খুব যে সুখী তা নয়। চক্রের পেছনে পড়ে তারা নিজেরাও সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। না বলা কষ্টও রয়েছে তাদের। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তাদের বিষয়ে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। পুংলিঙ্গ কর্তন করে হিজড়ায় পরিণত করার বিষয়টি লিঙ্গ কর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সার্জিক্যাল চিকিৎসকরাও স্বীকার করেছেন। সার্জিক্যাল ক্লিনিকে পুংলিঙ্গ কেটে বিশেষ বিশেষ ওষুধ সেবনের মধ্য দিয়ে তাদের লিঙ্গ কর্তন এবং শারীরিক অবয়বে পরিবর্তন আনা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের মধ্যে খোদ রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। রাজধানীসহ সারাদেশে অশিক্ষিত, অভাবী ছেলেদের পাশাপাশি যেসব ছেলের একটু মেয়েলি ঢং রয়েছে এবং যেসব ছেলে বা পুরুষ সমকামিতায় আসক্ত তারা নানা ফাঁদে পড়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। তাদের সংগ্রহের জন্য রয়েছে দালাল চক্র। আবার চিহ্নিত কিছু হিজড়া নেতাও ওইসব ছেলেদের হিজড়া বানাচ্ছে। যারা হিজড়া হচ্ছে তারা সবাই ৩০ বছর আগেই এই অপকর্ম সেরে ফেলছে। যেসব হিজড়া পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে, তারা সবাই হিজড়া হওয়ার পর পাল্টে ফেলে বাবা-মায়ের দেয়া নাম। হিজড়ার এ তালিকায় থাকা অনেকের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন থাকলেও সহজ পথে, অল্প সময়ে এবং নিরাপদে অর্থ আয়ের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছে। তবে তাদের অনেকেই এখন অনুতপ্ত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইলেও আর সম্ভব নয়। তাদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি সংগঠন, সমাজবিজ্ঞানী ও হিজড়া সংগঠনের কর্মকর্তারাও এসব ঘটনা স্বীকার করেছেন। এমনকি লিঙ্গ কর্তনকারী চিকিৎসকরাও যুগান্তরের কাছে এসব নির্মম ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন।
আপন, রহিমা, নাছিমা, জনা ও জয়াদের হিজড়া হওয়ার পেছনের কথা : জনার আগের নাম ছিল জাহাঙ্গীর। মানিকগঞ্জ জেলাধীন দৌলতপুর থানার দৌলতপুর পিএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র। দেখতে বেশ সুন্দর। নাদুস-নুদুস চেহারা। হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ। তার বাবা-মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন ছেলে কোথায় গেল। সব আত্মীয়-স্বজনের বাসায় খোঁজ করা হল। কিন্তু সন্ধান মেলে না। থানায় দায়ের করা হলো সাধারণ ডায়েরি। কিন্তু পুলিশও তার কোন হদিস পায়নি। আড়াই বছর আগের ঘটনা। এক রাতে জাহাঙ্গীর মানিকগঞ্জের ধনাই গ্রামে বাবার বাড়ি এসে হাজির। কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার কান্না থামতেই চায় না। তাকে অনেক বুঝানোর পর সে জানায়, হিজড়াদের একটি চক্র তাকে স্কুলের সামনে থেকে ফুসলিয়ে খুলনা ফুলতলা নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাকে একটি ক্লিনিকে ঢোকানো হয়। চিকিৎসকের হাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। জাহাঙ্গীর আঁতকে ওঠে। তাকে উলঙ্গ করে অস্ত্রোপচার বেডে চিৎ করে শোয়ানো হয়। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে। কিন্তু হিজড়া বাহিনী পিছু ছাড়ে না। তারা চাপ দেয় ডাক্তারকে। ব্যস। জাহাঙ্গীরের পুংলিঙ্গ কাটা পড়ল। সে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পর তাকে কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর তার নামকরণ করা হল জনা। সেই থেকে সে জনা হিজড়া। জাহাঙ্গীরের এক ভাই কাইয়ুম। থাকেন ঢাকায়। কাজ করেন ১৯২, ফকিরাপুলের একটি ছাপাখানায়। সেখানে গিয়ে কাইয়ুমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জাহাঙ্গীরের বয়স যখন ১৪ বছর তখন সে একটি চক্রের খপ্পরে পড়ে হিজড়াদের খাতায় নাম লেখায়। আমাদের ভাইদের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। সবার আদরের। কিন্তু তার লিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার পর সে আর বাড়িমুখী হয়নি। মাঝে মাঝে রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়িতে আসে। মা-বাবাকে এক নজর দেখে আবার চলে যায়। তার জন্য আমাদের পুরো পরিবারকে আজ চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে একই শ্রেণীতে পড়তো শাওন। সে জানায়, জাহাঙ্গীর ভালো ছাত্র ছিল। সে হিজড়া হয়েছে এটা শুনে আমরা সবাই খুব দুঃখ পেয়েছি। জাহাঙ্গীর এখন জনা হিজড়া নামে পরিচিত। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে নিজের ছবি পত্রিকায় না দেয়ার শর্তে যুগান্তরকে বলে, এটা আমার ভাগ্যে ছিল। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার কারণে আমার এই জীবনের আর কোন মূল্য নেই।
আপন হিজড়া : সোহেল মাহমুদ। এখন আপন হিজড়া। বয়স ২৭ বছর। তার পিতার নাম সিরু খাঁ। গ্রামের বাড়ি ভোলায়। বর্তমানে তার বাবা-মা ও ভাইবোন থাকেন দক্ষিণখান থানার ফায়দাবাদ এলাকায়। সে থাকে শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পেছনে বাউনিয়া এলাকায়। ফায়দাবাদ এলাকার জয়নাল মাতব্বরের বাড়িতে ১ বছর আগে ভাড়ায় থাকত আপনরা। গত ১৫ মার্চ ফায়দাবাদের ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এলাকার আবদুস সালাম, লাইলী বেগম ও রেহেনাসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা যুগান্তরকে জানান, আপনরা দুই ভাই ও ৪ বোন। তার বড় ভাই সুজন গাড়িচালক। এক বোন রেনু ৮ মাস আগে লেবাননে গেছে। আপন (সোহেল) যখন ৮ম শ্রেণীতে পড়তো, তখন সে হিজড়াদের সঙ্গে মেশা শুরু করে। লাইলী বলেন, একদিন আমার মেয়ে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সোহেলকে হিজড়াদের সঙ্গে নাচতে দেখে আমাকে এসে ঘটনা বলে। সে দিনই আমি জানলাম সে হিজড়াদের সঙ্গে চলাফেরা করে। মাঝেমধ্যে হিজড়াদের বাসায় নিয়ে আসত। আমরা তখনও বুঝেনি সে হিজড়ার খাতাই নাম লেখাবে। প্রায় ৮/৯ বছর আগে সোহেল হিজড়া হয়েছে। হিজড়া হওয়ার পর সে বাড়ি থাকত না। হিজড়াদের সঙ্গে থাকত। মাঝেমধ্যে বোরকা পরে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসত। এখন আর আপনকে দেখি না। কারণ তার মা-বাবা এলাকা ছেড়ে দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আপনের বাবা-মা লোকলজ্জার কারণে ফায়দাবাদের অন্য একটি বাড়িতে ভাড়া নেয়। ৪২ নং ফায়দাবাদের ওই বাড়িটি আরিফ নামের এক ব্যক্তির। সেখানে গিয়ে জানা যায়, আপনের কারণে তার বাবা-মা সেখান থেকে বাসা পাল্টিয়ে আবদুল্লাপুর আদম আলী মার্কেটের কাছে ভাড়া নিয়েছে।
অনুসন্ধানকালে আপনের সন্ধান পাওয়া যায়। তখন তারা ৭/৮ জন মিলে চাঁদার টাকা সংগ্রহ করে বাসায় ফিরছিল। ১৫ মার্চ দুপুরের ঘটনা। উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের জহুরা মার্কেটের সামনে কথা হয় আপন হিজড়ার সঙ্গে। সে যুগান্তরকে জানায়, বাউনিয়া এলাকায় একসঙ্গে তারা প্রায় ১৫ জন হিজড়া থাকে। তার দেয়া তথ্যমতে, একসঙ্গে থাকা সবাই লিঙ্গ কেটে হিজড়া হয়েছে। সে জানায়, আমিও ছেলে হয়েই জন্মেছিলাম। আমি আবদুল্লাহপুর মালেকাবানু আদর্শ বিদ্যা নিকেতনে পড়তাম। সেখান থেকে এসএসসি পাস করেছি। ২০০১ সালে আমি বাড়ি ছেড়ে হিজড়াদের সঙ্গে চলে আসি। এরপর ২০০৪ সালের দিকে খুলনার ফুলতলার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে লিঙ্গ কেটে ফেলি। এখন আমি পুরোপুরি হিজড়া। তবে আমার বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে এখনও সম্পর্ক আছে। আমার আয়ের একটা বড় অংশ বাবা-মাকে দিই। আপন বলে, রাস্তায় আমার মায়ের সঙ্গে দেখা হলে মা কথা বলে না। আমাকে দেখলে কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ লুকায়। আমি হিজড়া হয়েছি এতে আমার মা-বাবা লজ্জা পায় সমাজে। আমার এক বোন লেবাননে থাকে। আরেক বোন উত্তরায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। এসব বলতে বলতে চোখের পানি ছেড়ে দেয় আপন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাই রাতে। তাও আবার বোরকা পরে। মানুষ আমাকে দেখলে বাসায় এসে ভিড় জমায়। মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে খোলামেলা মিশতে, তাদের সঙ্গে থাকতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু এই ইচ্ছা আর পূরণ হওয়ার নয়।
রহিমা হিজড়ার কথা : নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মিজমিজি গ্রামে বাড়ি ছিল রহিমের। তারা দুই ভাই আর এক বোন। বেশ কয়েক বছর আগে রহিম থেকে রহিমা হয়ে যায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। এখন পুরোদস্তুর মেয়ের মতো দেখালেও রহিমা লিঙ্গ কর্তন করা একজন হিজড়া। রহিম থেকে রহিমা হিজড়া। এরপর সে আর বাড়ি যায় না। থাকে রাজধানী সংলগ্ন কাঁচপুরে। গত ১০ মার্চ রহিমার সঙ্গে কথা হয়। রহিমা জানায়, বাবা-মায়ের ছোট ছেলে ছিলাম আমি। আমার নাম ছিল রহিম। শখ ছিল পাখি শিকারের ও নাচ-গানের। তরুণ বয়সেই আমি সমকামিতায় আসক্ত হয়ে পড়ি। তখন আমার বয়স ১৫ কি ১৬ বছর। নারায়ণগঞ্জের খালেক নামের এক হিজড়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের অল্পদিনের মধ্যে তার সঙ্গে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি। আমাকে হিজড়া হওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে লাগল খালেক। আমিও তার কথায় রাজি হয়ে যাই। সেই থেকে হিজড়া। সে জানায়, ভারতের বিহার প্রদেশের পাটনা-ছাপড়া এলাকায় গিয়ে সে তার লিঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে এসেছে। সেই সময় সে প্রচুর পরিমাণে ওষুধ সেবন করেছে। সে যুগান্তরকে জানায়, পরবর্তীতে আমি ভারতে গিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় অপারেশন করে স্ত্রী লিঙ্গ বানিয়ে নিয়ে এসেছি। জীবনের এ পর্যায়ে এসে আজ আমি অনুতপ্ত। যে ভুল করেছি তার মাশুল দিতে হচ্ছে সারাজীবন। এখন আমি মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন। না আছে সংসার, না আছে আত্মীয় স্বজন।
নাছিমা হিজড়ার কথা : বাবা-মায়ের দেয়া নাম আসিফ। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। দুই ভাই, দুই বোন। বাবা দরিদ্র কৃষক। সংসারের অভাব ঘুচাতে ২০০১ সালে ঢাকায় আসে। তখন বয়স ছিল ১৬ বছর। কাজ নেয় ফকিরাপুলের একটি ছাপাখানায়। নাছিমা বলে, ছাপাখানায় কাজ করার সুবাদে পরিচয় হয় আরিফা নামের এক হিজড়ার সঙ্গে। আরিফা আমাকে নিয়ে যায় তাদের গুরু মায়ের কাছে। গুরু মা আমাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে প্রেসের কাজ ছেড়ে হিজড়া সম্প্রদায়ে আসতে বলে। আর এজন্য তিনি সব খরচ বহন করবেন বলে জানায়। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে গুরু মা আমাকে খুলনার ফুলতলার একটি ক্লিনিকের কর্মচারী রফিকের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে একটি ক্লিনিকে ঢুকানো হয়। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে। জ্ঞান ফেরার পর দেখি পুরুষাঙ্গ নেই। ব্যান্ডেজ করা। এরপর গুরু মা আমার নাম দেয় নাছিমা। বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে আমি স্তন বড় করেছি। নাছিমা এখন মতিঝিল এলাকার হিজড়া। যাত্রাবাড়ী এলাকার হিজড়াদের নেতা দিপালীর এক শিষ্য বৃষ্টি। সেও গত ফেব্র“য়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ধামরাই রোম আমেরিকান হাসপাতাল থেকে লিঙ্গ কাটায়।
আবুল হিজড়া : যাত্রাবাড়ী ধলপুর লিচুবাগানে থাকে আবুল হিজড়া। সে যাত্রাবাড়ী এলাকার হিজড়াদের দলনেতা। আবুল হিজড়ার ভাগ্নে রবিন যুগান্তরকে জানায়, আবুল হিজড়া আমার ছোট মামা। আমার আম্মার কাছে শুনেছি, মামা ২০ বছর বয়সে লিঙ্গ কেটে হিজড়া হয়ে যায়। এ কারণে মামা বিয়ে করতে পারেনি। একটি মেয়ে ও একটি ছেলে দত্তক নিয়ে মানুষ করছে। মনু হিজড়ার খপ্পরে পড়ে আবুল হিজড়া হয়েছে বলে জানা যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তান রয়েছে এমন হিজড়ার সংখ্যাও কম নয়। তাদেরই একজন মগবাজার এলাকার হান্নান। এমন আরেকজন হলো বাড্ডা এলাকার পলি হিজড়া। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়। সেখানে তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। বনশ্রী এলাকার বিউটি হিজড়ার আসল নাম ফালা হোসেন। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। সেখানে তার এক ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। বিউটি হিজড়া স্ত্রীর কাছে প্রতিমাসে টাকা পাঠায়। বরিশাল জেলার রাজ্জাক। কামরাঙ্গীরচর এলাকার রিজিয়া হিজড়া। তার দুই ছেলে আছে। গাজীপুর বোর্ডবাজার এলাকার লাইলীও স্ত্রী-সন্তান রেখে হিজড়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। সেখানে তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে থাকে।
হিজড়াদের সঠিক পরিসংখ্যন নেই : হিজড়াদের কাজ করেন এমন সংগঠন বা সমিতির কাছে এমনকি রাষ্ট্রের কাছেও হিজড়াদের কোন পরিসংখ্যন নেই। হিজড়াদের সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় ৪০ হাজার থেকে দেড় লাখ এমএসএম (পুরুষ সমকামী) রয়েছে। সারাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ৫০ হাজার হিজড়া রয়েছে। অন্যদিকে সমাজ বিজ্ঞানী ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস যুগান্তরকে জানান, ডেমোগ্রাফি সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে সমকামী ও হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এর মধ্যে ঢাকায় হিজড়ার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। ঢাকায় সমকামীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।
যেখানে কাটাকাটি হয় : ঢাকা জেলার ধামরাই এলাকার রোম আমেরিকান হাসপাতাল নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিমাসে ৪/৫ জনকে পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীর শ্যামলী ও খুলনার ফুলতলার কয়েকটি ক্লিনিকেও লিঙ্গ কেটে হিজড়া করা হয়। হিজড়াদের দলনেতারা নানা প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সের ছেলেদের ওইসব হাসপাতালে নিয়ে তাদের হিজড়া বানিয়ে নিজেদের দল ভারি করছে। রোম আমেরিকান হাসপাতালে পুরুষাঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে হিজড়া বানানো হয় এমন অভিযোগ পেয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে ওই হাসপাতালে অনুসন্ধান চালানো হয়। ১২ মার্চ ধামরাই থানা বাসস্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে জানা যায় লোমহর্ষক এ ঘটনার সত্যতা। থানা বাসস্ট্যান্ডে থেকে ৫০ গজ দূরে মানিকগঞ্জ-ঢাকা প্রধান সড়কের পাশেই ‘রোম আমেরিকান হাসপাতাল’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই হাসপাতালের মালিক ডাক্তার গোলাম রহমান শাহজাহান নিজেই হিজড়া বানান। কর্মচারী মোশারফ যুগান্তরকে জানান, প্রায়ই এ হাসপাতালে ছেলেরা এসে কিসব অপারেশন করে। এ জন্য ডাক্তার ১৫/২০ হাজার টাকা নেয়। হিজড়ারা তাদের নিয়ে আসে। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে হিজড়াদের একটি গ্রুপ একজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। পরে আরেক গ্রুপ এসে মারামারি করে। প্রায় ৫০/৬০ জন হিজড়া সেদিন হাসপাতালে এসেছিল। পরে জানা যায়, ওই ছেলেটির নাম রাখা হয়েছে বৃষ্টি। জানা যায়, ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। চাকরির পাশাপাশি এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এলাকাবাসী মানিক জানান, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে এ হাসপাতালটি থানা রোডের লুৎফর নায়েবীর ৩ তলায় শুরু করেন ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান। আনিছ নামের এক ব্যক্তি জানান, ওই ক্লিনিকে সাধারণ কোন রোগী যান না। মূলত লিঙ্গ কেটে হিজড়া তৈরিই ওই ডাক্তারের মূল কাজ। সূত্র জানায়, একই কায়দায় খুলনা ফুলতলার একটি ক্লিনিকে লিঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হয়। এছাড়া রাজধানীর শ্যামলী এলাকায়ও একটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে লিঙ্গ কাটতে গিয়ে এক যুবকের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। তবে ওই ক্লিনিকটি কিছুদিন আগে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে রোম আমেরিকান হাসপাতালের কর্ণধার ডা. গোলাম রহমান শাহজাহান যুগান্তরের কাছে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি তো জোর করে কারও পুংলিঙ্গ কাটি না। ছেলেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই এসে পুরুষাঙ্গ কাটতে বলে। তিনি নিজেই কিছু তথ্য দেন। তিনি জানান, প্রতিমাসে ৩/৪ জন ছেলেকে অপারেশনের জন্য হিজড়ারা ধরে নিয়ে আসে। এরা আমার কাছে রোগী। কত দিন ধরে এ ধরনের কাজ করছেন এবং এ পর্যন্ত কতজনের পুরুষাঙ্গ কেটেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা থেকেই পুরুষাঙ্গ কাটা হয়। প্রতিমাসে রোগী আসে। তবে এর সঠিক হিসাব জানা নেই। এসব অপারেশন করতে ১০ হাজার টাকা নিই। লিঙ্গ কাটতে গিয়ে কেউ মারা গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার হাসপাতালে কেউ মারা যায়নি। শ্যামলীর একটি ক্লিনিকে পুরুষাঙ্গ কাটতে গিয়ে একজন মারা গেছে।
পুলিশের ভাষ্য : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম অভিনব পন্থায় হিজড়া তৈরির খবর শুনে বিস্মিত হন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া বানাচ্ছে এ ধরনের কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারও অঙ্গহানি করা পেনালকোডে ৩২৬ ধারায় অপরাধ।
বিশেষজ্ঞদের কথা : হরমোন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোঃ হাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পুরুষাঙ্গ কেটে হিজড়া হলে তাদের জীবনে ভয়াবহ ঝুঁকি থাকে। দেহের হাড় ক্ষয় হয়, শারীরিক শক্তি কমে যায়। এছাড়া নানা রোগের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে হিজড়া বলতে তাদের বোঝায় যারা শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নিজেদের মেয়ে ভাবে, মেয়েদের পোশাক পরতে ও মেয়েদের মতো ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এটা হরমোনজনিত বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জাতীয় এইডস বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, লিঙ্গ কাটলে তাদের হিজড়া বলা যাবে না। তারা হল বিকলাঙ্গ। লিঙ্গ কাটার কারণে ওই ব্যক্তি পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, সাাংস্কৃতিক সমস্যা ও হীনমন্যতায় ভুগবে। সমাজ তাকে দূরে রাখবে। লিঙ্গ কাটা সমাজে মারাÍক ধরনের অপরাধ। এর সঙ্গে যে দুষ্টচক্র জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে দুষ্টচক্রটি। রাষ্ট্রকে এর বিহিত করতে হবে, নইলে সমাজ অধপতনের দিকে ধাবিত হবে।
পুংলিঙ্গ কেটে হিজড়া হওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা যুগান্তরকে বলেন, তার জানামতে, অনেক ছেলে স্বেচ্ছায় হিজড়া হচ্ছে। জয়া হিজড়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ছেলে জয় পুংলিঙ্গ কেটে এখন জয়া। তাকে নিয়ে আমি টেলিভিশনে একটি প্রোগ্রামও করেছি। পরে জেনেছি তার হিজড়া হওয়ার কাহিনী। তাদের নিয়ে আলাদা কোন আইন নেই।
-বকুল আহমেদ। যুগান্তর

সৌজন্যে @ "https://techspacebd.wordpress.com/2012/07/02/pulingo-kata-hijra-banano-hocca/"

তৃতীয় লিঙ্গ: অভিশপ্ত শিখণ্ডীগণ এখনও স্বীকৃতির খোঁজে।

মহাভারতের অম্বা এক অভিশপ্ত চরিত্র। ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য ভীষ্ম স্বয়ংবর সভা থেকে অম্বাকে নিয়ে আসে হস্তিনাপুরে। কিন্তু শাল্বরাজার প্রতি অম্বার অনুরাগের কথা জানতে পেরে ভীষ্ম মুক্তি দেয় অম্বাকে। অন্যদিকে শাল্বরাজ অম্বাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রত্যাখ্যাত হয়ে অম্বা এই ঘটনার জন্য ভীষ্মকে দায়ী করে এবং তাকে ধ্বংস করার কঠিন তপস্যায় ব্রতী হয়। শিভ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দেয়- পরজন্মে অম্বা নপুংসক শিখণ্ডী হয়ে জন্ম নিয়ে ভীষ্ম-বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
পৌরাণিক এই চরিত্র অম্বার অভিশপ্ত জীবনই বয়ে বেড়াচ্ছে তার উত্তরসূরিরা- আজকের হিজড়া! এদের লিঙ্গই এদের জন্য অভিশাপ। সভ্যতার জীবন ধারায় এই সকল যৌন প্রতিবন্ধীরা সবসময়ই হয়ে এসেছে উপেক্ষিত ও নির্যাতিত। ‘হিজড়া’ যুগ যুগ ধরে সামাজিক পরিবর্তন ও বিবর্তনের মাঝ দিয়ে বয়ে এসেছে এক প্রবাহরুপে যারা এখনও সন্ধানে আছে সমাজে তাদের সঠিক অবস্থানের। বিশেষ করে উপমহাদেশের অনুন্নত জীবনযাত্রায় এরা অত্যন্ত মানবিক জীবন যাপন করে চলছে।
হিজড়ে: হিজড়া- কথ্য ভাষায় । অর্থাৎ একই দেহে স্ত্রী এবং পুং চিহ্নযুক্ত মানুষ, ক্লীব, নপুংসক, উভলিঙ্গ। ইংরেজি ভাষায় Hermaphrodite।
হিজড়ে কারো কাছে আতঙ্কের, কারো কাছে ঠাট্টার এবং কারো কাছে কৌতূহলের বস্তু। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এই স্রোতের সাথে আমাদের বিশাল দুরুত্বই তাদের সম্পর্কে আমাদের করে রেখেছে অজ্ঞ আর তাদের করে রেখেছে অবজ্ঞার পাত্র। ছোটবেলায় পাড়ায় হিজড়ে এসেছে শুনলেই আমরা দৌড়ে যেতাম দেখতে। তাদের অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা, ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর এবং অদ্ভুত রকম তাদের তালি বাজানো সবকিছুই ছিল ভিন্নরকম ও বিনোদনের খোরাক। দুঃখের বিষয় আজও হিজড়েরা আমাদের কাছে বিনোদন মাত্রই। আমরা অনেকেই জানি না হিজড়ে কেন হয়? কারা হয়? কেমন তাদের জীবনযাত্রা? কেন তারা আর দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবিকা নির্বাহ না করে দোকানে দোকানে ঘুরে টাকা তোলে, অনুষ্ঠানে গিয়ে নাচ গান করে বেড়ায়?
হিজড়ে কারা:
হিজড়ে সাধারণত তিনরকম: প্রকৃত হিজড়ে ( True Hermaphrodite), অপ্রকৃত পুরুষ হিজড়ে (Male Pseudo Hermaphrodite), এবং অপ্রকৃত নারী হিজড়ে (Female Pseudo Hermaphrodite)।
অপ্রকৃত হিজড়ে (Pseudo Hermaphrodite)
গর্ভে থাকাকালীন সময়ে অন্যান্য শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মতই শিশুর যৌনাঙ্গ গঠিত হয়। যৌনাঙ্গ গঠনে ক্রোমোজোমের ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ক্রোমোজোমের ত্রুটিবিচ্যুতির ফলেই জন্ম নেয় যৌন প্রতিবন্ধী শিশু। ক্রোমোজোমের ভিত্তিতে লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যবস্থায় এই যৌন বিকলাঙ্গরা তাই হয়ে উঠে অপ্রতিভ।
সাধারণত পাঁচ ধরনের অপ্রকৃত হিজড়ে দেখা যায়-
১. ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter syndrome)
১৯৪২ সালে এইচ.এফ. ক্লাইনেফেলটার (H.F Klinefelter) নামে একজন আমেরিকান চিকিৎসক এই রোগ আবিষ্কার করেন। এই শারীরিক ত্রুটি শুধু পুরুষের ক্ষেত্রে দেখা দেয় ।
প্রতি ১০০০ জন পুরুষের ভিতর ১ জনের এই ত্রুটি দেখা দিতে পারে। টেস্টোস্টেরন (Testosterone) হরমোনের অভাবে এদের শারীরিক গঠনে পুরুষালী পেশীর ঘাটতি দেখা দেয়। মুখে দাঁড়ি গোঁফ (Facial Hair), যৌনাঙ্গে চুল (Pubic Hair) কম দেখা দেয়। বক্ষ কিছুটা উন্নত হয় ও স্ফীত স্তন দেখা দেয়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে গাইনিকোমাস্‌টিয়া (Gynecomastia) বলে। তবে মাত্র ১০% পুরুষের গাইনিকোমাস্‌টিয়া লক্ষণযোগ্য হয়। বাকিদের গঠন স্বাভাবিক পুরুষের মতই। এদের শুক্রাশয় স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট থাকে। সেখানে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় না। এরা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলেও স্বাভাবিক যৌন জীবন পালন করতে পারে। এরা মানসিক জড়তায় ভোগে।
কারণ:
অতিরিক্ত একটি X ক্রোমোজোমের কারণে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের উদ্ভব ঘটে। স্বাভাবিক পুরুষের সেক্স ক্রোমোজোম XY বিন্যাস এবং নারীর ক্ষেত্রে XX । কিন্তু এই সিনড্রোম ধারী পুরুষদের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম বিন্যাস দাঁড়ায় XXY। এই সিনড্রোমে আক্রান্ত সকল ব্যক্তির দেহকোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা এক হয় না। যৌন ক্রোমোজোমের অপ অবস্থান ও বিকৃতির ফলে অনেকের ক্রোমোজোম সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮। এর মধ্যে যৌন ক্রোমোজোম XXYY। এর সম্ভাবনা প্রতি ১৮০০০- ৪০০০০ এর ভিতরে একজনের।
২. XXY পুরুষ (XXY Male)
আপাত গঠন পুরুষের মতো। এদের যৌনাঙ্গের অস্বাভাবিকতা বয়ঃসন্ধিকালের ভিতর প্রকাশ পায়। শিশ্ন আছে। তবে মূত্রছিদ্রটি (Urethral Orifice) শিশ্নের স্বাভাবিক স্থানে থাকে না। ডাক্তারি ভাষায় একে হাইপোস্পেডিয়াস (Hypospadias) বলে। এদের অণ্ডকোষ শরীরের অভ্যন্তরে থাকে । একে বলে গুপ্ত শুক্রাশয় (Cryptorchidism)।
কারণ:
যৌন ক্রোমোজোমের অপ অবস্থান এর কারণ। এই রোগীদের শরীরে ক্রোমোজোমের মোট সংখ্যা ৪৭। এর ভেতর ৪৪টি অটোজোম আর তিনটি সেক্স ক্রোমোজোম XXY।
৩. XX পুরুষ (XX)
XX পুরুষের সাথে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের অনেক মিল আছে। প্রতি ১০,০০০০ জনের ভিতর ৪ অথবা ৫ জনের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এদের স্তন থাকে। তবে সুডৌল, স্ফীত স্তন নয়। এদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ২ সেন্টিমিটারেরও ছোট শুক্রাশয় থাকে। সেখানে শুক্রাণু (Spermatozoa) উৎপন্ন হয় না। এদের হাইপোস্পেডিয়াসের সমস্যা থাকে। এরা বেঁটে হয়।
কারণ:
পিতার শরীরে সংঘটিত মিয়োসিস পর্যায়ে X এবং Y ক্রোমোজোমের অসমান ক্রসিং ওভারের ফলস্বরুপ X ক্রোমোজোম স্বাভাবিক-পুরুষ জীন SRY বহন করে। উক্ত X ক্রোমোজোম যখন আরেকটি স্বাভাবিক X ক্রোমোজোমের সাথে মিলিত হয়ে মাতার শরীরে ভ্রূণ তৈরিতে অংশগ্রহণ করে তখন তা XX পুরুষ হিজড়ে জন্ম দেয়।
৪. টার্নার সিনড্রোম (Turner Syndrome)
১৯৩৮ সালে হেনরি টার্নার ডাক্তারি অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে এই ধরনের রোগের কারণ নির্ণয় করেন। প্রতি ২৫০০ মহিলাদের ভিতর একজনের এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত একটি X ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি এই রোগের কারণ।
আপাতদৃষ্ট মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সিনড্রোম দেখা দেয়। জন্মের প্রথম তিন বছর এদের উচ্চতা স্বাভাবিক দেখা দিলেও এরপর থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির হার কমে যায়। যোনিকেশ (Pubic Hair) খুব কম দেখা দেয়। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে সেক্স হরমোন- ইস্ট্রোজেন (Estrogen) ও প্রোজেস্টেরন (Progesterone) নির্গত হওয়া শুরু করে। কিন্তু টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সেক্স হরমোনের প্রকাশ ঘটে না। ফলে রজঃচক্র বা মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রশস্ত বুকে স্তন গ্রন্থির উদ্ভব হয়। গলার দু-দিকের পুরু মাংসল কাঁধ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এদের বধির হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। এরা অস্থি সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুবিধা ও অস্বাভাবিকতায় ভোগে।
অনুন্নত ডিম্বাশয় ও গর্ভধারণে অক্ষম হলেও টার্নার সিনড্রোমে আক্রান্ত কারো কারো স্বাভাবিক যোনিপথ ও জরায়ু থাকে।
কারো কারো ক্ষেত্রে গণিত শিক্ষা অথবা স্মৃতি ধারণ ক্ষমতায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
কারণ:
টার্নার সিনড্রোমের রোগীদের কোষের ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৫ অর্থাৎ অটোজোম ৪৪টি আর সেক্স ক্রোমোজোম ১টি X। স্বাভাবিক নারীদের ক্ষেত্রে বারবডি পজিটিভ থাকে। বারবডি হল পলিমরফো নিউক্লিয়াস যুক্ত শ্বেত কণিকায় ড্রামস্টিকের (Drumstick) মত দেখতে নিউক্লিয়াস অঙ্গাণু। সাধারণত নারীর ক্ষেত্রে এই পলিফরমো নিউক্লিয়াস যুক্ত শ্বেত কণিকায় শতকরা ৫ ভাগ ড্রামস্টিক দেখা যায় তাই নারীর শরীরে বারবডি পজিটিভ কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে এই ড্রামস্টিক অনুপস্থিত থাকে বলে পুরুষের ক্ষেত্রে বারবডি নেগেটিভ। । কিন্তু টার্নার সিনড্রোমের মহিলাদের ক্ষেত্রে বারবডি নেগেটিভ থাকে। একদিকে ‘Y’ ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি যেমন পুরুষালী ভাব প্রকাশে অসহযোগিতা করে তেমনি বারবডি না থাকায় নারীসুলভ ভাবও প্রকাশ পেতে পারে না।
অনেকের দেহকোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা একটু ভিন্নতর হতে দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফিমেল পলিজোমি (Female polysomy)। এদের ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৭ (৪৪XXX)। এছাড়াও মিশ্র ক্রোমোজোম অপেরণও (Mixed Choromosomal Aberration) দেখা যায়।
৫. মিশ্র যৌন গ্রন্থির বিকৃতি (Mixed Gonadal Dysgebesis-MGD)
গোনাড হল দেহের সেক্স অর্গান। পুরুষের থাকে শুক্রাশয় আর নারীর থাকে ডিম্বাশয়।
MGD সিনড্রোম ধারীদের আপাতদৃষ্টিতে পুরুষ বলে মনে হয়। শুক্রাশয় থাকে তবে একটি। এর গঠন জটিল আকারের। প্রতিটা শুক্রাশয়ে ৪০০-৬০০ টির মতো শুক্রোৎপাদক নালিকা (Seminiferous Tube) থাকে। এর ৫টি স্তর- স্পার্টাগোনিয়া (Spermatogonia), প্রাথমিক স্পার্টোসাইট (Primary Spermatocyte), গৌণ স্পার্মাটোসাইট (Secondary Spermatocyte), স্পার্মাটিড (Spernatid) ও স্পার্মাটোজোয়া (Sprematozoa)। এই পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়েই শুক্রাণু তৈরি হয়। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উল্লেখিত ৫টি পর্যায়ে বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে শুক্রাণু গঠন হয় না। শিশ্ন থাকা সত্ত্বেও এদের শরীরে যোনি (Vagina), জরায়ু (Uterus) ও দুটি ফেলোপিয়ান নালীর (Fallopian Tube) অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বিকৃত যৌন গ্রন্থির উপস্থিতির ফলে এদের জননকোষের উৎপত্তি স্থানে গোনাডাল টিউমার (Gonadoblastoma) দেখা দিতে পারে। ২৫% MGD আক্রান্ত ব্যক্তিদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
কারণঃ
প্রধানত ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির নানারকম ত্রুটি ও জননকোষের উৎপত্তি স্থানের নানা জটিলতার ফলে এই ধরনের রোগের উদ্ভব ঘটে। এদের ক্রোমোজোম সংখ্যা হয় ৪৬ (৪৫X)।
প্রকৃত হিজড়ে (True Hermaphroditism)
এদের শরীরে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় উভয়ই অবস্থান নেয়।
এরা অধিকাংশই পেশীবহুল শরীরের অধিকারী থাকে। শিশ্ন থাকে।
অল্প হলেও কারো কারো শিশ্নের বদলে যোনি থাকে। এবং ভগাঙ্কুর (Clitoris) স্বাভাবিকের তুলনায় বড় থাকে অনেক সময় তা পুরুষ শিশ্নের মত হয়ে থাকে। এদের মূত্রনালি ও যোনিপথ একসাথে থাকে। একে বলে ইউরোজেনিটাল সাইনাস (Urogenital Sinus)। ফেলোপিয়ান নালী (Fallopian Tube) ও জরায়ু (Uterus) থাকে। জরায়ু অত্যন্ত ছোট হয়। চিকিৎসার ভাষায় একে বলে হাইপোপ্লাস্টিক বা ইউনিকরনেট্‌ (Hypoplastic or Unicornuate)। কৈশোরে স্তন গ্রন্থির প্রকাশ ঘটে ও রজঃচক্র (Menstruation Cycle) শুরু হয়।
যাদের বাহ্যিক জনন অঙ্গ পুরুষের মতো অর্থাৎ শিশ্ন আছে তাদেরও রজঃচক্র হয়ে থাকে। একে বলে সাইক্লিক হেমাচুরিয়া (Cyckic Hematuria)। এ ধরনের রজঃচক্রের সময় শুক্রাশয়ে ব্যথা হয়।
কারণ:
ক্রোমোজোম সংখ্যা ৪৮ (৪৬XX)। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৪৬XY। ডিম্বাশয় থেকে ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণের ফলে নারীসুলভ ভাব এবং শুক্রাশয় থেকে এন্ড্রোজেন হরমোন নিঃসৃতের ফলে পুরুষসুলভ ভাব প্রকাশ পায়।
গোনাডের ত্রুটি:
ক্রোমোসোম স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় গোনাডের ত্রুটির ফলেও শিশু যৌন বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়।
যৌনাঙ্গ সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ নালী মুলেরিয়ান নালী (Mullerian Duct) ও উলফিয়ান নালী (Wolffian Duct) নিয়ন্ত্রণ করে গোনাড। শুক্রাশয় থেকে নির্গত অ্যান্টি মুলেরিয়ান ফ্যাক্টর বা মুলেরিয়ান ডাক্ট ইন্‌হিবিটর (Anti Mullerian Factor or Mullerian Duct Inhibitor) নারী যৌনাঙ্গ সৃষ্টিতে বাধা দেয় এবং শুক্রাশয় থেকে নির্গত টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষাঙ্গ গঠন করে। কিন্তু যদি দুটোর একটি নিঃসৃত হয় কিন্তু অপরটির নিঃসরণ বন্ধ থাকে তবে লিঙ্গ গঠনে সমস্যা দেখা দিবে। এর জন্য সাধারণত দু ধরনের হিজড়ে জন্ম হয়- পিওর গোনাডাল ডিস্‌জেনেসিস্‌ (Pure Gonadal Dysgenesis) এবং অ্যাবসেন্ট টেস্‌টেস্‌ সিনড্রোম (Absent Tests Syndrome)।
হরমোন ও এনজাইমের ত্রুটি:
শুধুমাত্র এনজাইমের (Enzyme) ও কিছু বিশেষ হরমোনের (Hormone) ত্রুটির ফলেও জন্ম নিতে পারে হিজড়ে শিশু। মানুষের দেহের বৃক্কের ওপরে মোরগের ঝুটির মতো দেখতে ত্রিভুজাকার গ্রন্থি অ্যাড্রিনাল বা সুপ্রারেনাল (Adrenal or Suprarenal)। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির বহির্ভাগ কর্টেক্স (Cortex) থেকে নিঃসৃত হয় গ্লুকোকর্টিকয়েড (Glucocorticoid) নামক হরমোন। অন্যদিকে শুক্রাশয় থেকে নির্গত হয় টেস্টোস্টেরন (Testosterone) এবং অ্যান্ড্রোজেন (Androgen) নামক হরমোন। এখন গ্লুকোকর্টিকয়েড (Glucocorticoid) ও অ্যান্ড্রোজেন (Androgen) উভয় হরমোন তৈরিতে ও সংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে কাজ করতে তিনটি এনজাইম সাহায্য করে- ২০,২২ ডেসমোলেজ (20,22 Desmolase), ৩β হাইড্রক্সিস্টেরয়েড ডিহাইড্রোজিনেজ (3β Hydroxysteroid dehydrogenase), এবং ১৭α হাইড্রক্সিলেজ (17α Hydroxylase)। এই এনজাইমের কোন একটির অভাব হলেই লিঙ্গ নির্ধারণ জটিল হয়ে উঠে। এদের অপ্রকৃত হিজড়ে (Pseudo Hermaphrodite) বলা হয়। পুরুষ ও মহিলা দুইপ্রকার অপ্রকৃত হিজড়েদের মধ্যে আপাত সাদৃশ্য খুব প্রকট তাই বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণের পক্ষে পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
চিকিৎসা:
ক্রোমোজোমের ত্রুটি ব্যতীত অন্য সব বিচ্যুতির পূর্ণ সমাধান করা সম্ভব। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা এক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়েছে। হরমোন রি-প্লেসমেন্ট থেরাপির সাহায্যে হরমোনের প্রয়োজনীয়তা মেটানো যায়। যোনি সম্পর্কিত ত্রুটি চিকিৎসার ভাষায় যাকে বলা হয় Vaginal Anomalies , দূর করা সম্ভব কৃত্রিম যোনিপথ তৈরি করে। অদূর ভবিষ্যতে এই বিদ্যায় উন্নতির ফলে জন্মগত হিজড়ে শিশু কম জন্মানো সম্ভব।
অনেকেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ নারীতে পরিণত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। এদের রুপান্তরকামী (Transgendered) বলা হয়। তবে এ অপারেশন অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিধায় এর জন্য অর্থ বহন করা আমাদের মতো অনুন্নত দেশের হিজড়েদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।
জীবন ও জীবিকা:
শিখণ্ডীদের সমাজ জীবন আমাদের থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। তারা জোট হয়ে একত্রে বসবাস করে। এদের আলাদা কমিনিউটি থাকে। ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় যেমন পুরনো ঢাকা, শ্যামপুর, ডেমরা ও ফতুল্লা, নয়াবাজার ও কোতোয়ালী, সাভার, ধামরাই, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এসকল এলাকায় হিজড়েদের ডেরা খুঁজে পাবেন। প্রতিটি হিজড়ে বাড়ির তত্ত্বাবধানে থাকে একজন গুরু মা। এখানেই হিজড়েদের শেখানো হয় নাচ, গান এবং দু হাত দিয়ে কিভাবে অদ্ভুত তালির আওয়াজ সৃষ্টি করা যায়। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এবং ভয় ভীতি প্রদর্শন করে কিভাবে লোকজনের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে হয় তার প্রশিক্ষণও দেয়া হয় এখানে। আর এভাবেই তৈরি করা হয় হিজড়েদের তাদের অস্বাভাবিক জীবন পথের প্রতিকূলতায় অস্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার কৌশল। কোথাও নতুন কোন হিজড়ে জন্ম নিলে হিজড়েরা জোট বেধে সেখানে যায় বাচ্চাটিকে তুলে আনতে। হিজড়ে শিশু জন্ম দেয়া পরিবারটির যদি আর্থিক সঙ্গতি না থাকে তবে বাবা মায়েরা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে শিশুটিকে দিয়ে দেয়াই শ্রেয় মনে করে। আর যদি না দিতে চান তবে মোটা অঙ্কের বখশিশ দিয়ে তবেই হিজড়েদের বিদায় করা যায়। অনেক সময় দেখা যায় শিশুটি বড় হয়ে স্বেচ্ছায় অংশ নেয় হিজড়ে বাড়িতে। হয়ত পারিপার্শ্বিক অবহেলা, অবজ্ঞা ও কটাক্ষপূর্ন মন্তব্য তাকে বাধ্য করে সমাজ থেকে বহির্ভূত এই জীবনে প্রবেশ করতে। এছাড়াও এইসব বাড়ি কিংবা মহল্লার সকল সদস্যই তার নিজের মতই- অবহেলিত ও বঞ্চিত, যা তাকে অস্তিত্বহীনতা ও একাকীত্ব থেকে বাঁচায় এবং মানসিকভাবে প্রশান্তি দান করে। পরিবারের মতো জোট বেধে থাকলেও হিজড়ে মহল্লা কখনই তাদের জীবনে পরিবারের অভাব পূরণ করতে পারে না। একেকটি হিজড়ে কমিউনিটি গড়ে উঠে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে। কমিউনিটির প্রতিটি হিজড়ে সদস্যকে অবৈধ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিমাসে স্থানীয় দোকান থেকে চাঁদা উঠানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নাচ গান করা, জোর করে বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে টাকা চাওয়া এবং যৌনকর্মী হয়ে অসাধুভাবে বেঁচে থাকার ব্যস্ততায় কেটে যায় এদের দিন। প্রতিষ্ঠিত ও স্বাবলম্বী জীবন যাপনের উপযুক্ত শিক্ষা এখানে কাউকে দেয়া হয় না। এইসব বাড়ীর একেকজন হিজড়ে সদস্য একেকজন উপার্জন যন্ত্র মাত্র!
খোঁজাকরনঃ
খোঁজা করন বা লিঙ্গ কর্তনের মত ভয়ঙ্কর আইন বিরুদ্ধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড হিজড়ে সম্প্রদায়ের সঙ্গী। অনেকেই হিজড়ে কমিউনিটিতে যোগদান কালে নিজের শিশ্ন স্বেচ্ছায় কর্তন করে। কেউ করতে না চাইলে তাকে জোর করা হয়। এছাড়া সুশ্রী দেখতে বালকদের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে এদের শিশ্ন ও অণ্ডকোষ কেটে এদের খোঁজা করে দেয়া হয় এরপর হিজড়ে বানিয়ে যৌন ব্যবসায় নামানো হয়। লিঙ্গ অপসারণ ব্যয়বহুল ও অনৈতিক বিধায় হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে এর কর্তন সম্পন্ন করা হয়। এতে প্রচুর রক্তপাত ঘটে। বেশিরভাগই প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়। এ সম্পর্কে ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ (Bandhu Social Welfare Society ) এর পরিচালক শালে আহমেদ বলেন-
However, in reality there are many who simply decide to enter this community because of hardships they suffer in life, economic or otherwise. Some are forced into it. They leave their old family and find a new one. They all have to be castrated, according to the rules. Many of them try getting this operation done in the hands of quack doctors and die. So there are only just a few properly castrated hijras out there”.
অধিকার প্রসঙ্গে:
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নং আর্টিকেলে বলা আছে-
“All Citizens are Equal before Law and are Entitled to Equal Protection of Law”
এ দেশের সংবিধান শুধু ‘নারী’ এবং ‘পুরুষ’ এই দুটি লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়। তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়েদের স্বীকৃতি না দেয়ায় নিজেদেরকে ‘পুরুষ’ কিংবা ‘নারী’ যেকোনো একটি লিঙ্গের হয়ে পরিচয় প্রদান করতে হয়। ফলস্বরুপ ভোটাধিকার প্রয়োগ, বিবাহ, নিজস্ব পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, চাকরি কিংবা স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে তারা সমান অধিকার ভোগ করতে পারে না।
প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ.কে.এম নজরুল ইসলাম (১৯৭৭-১৯৮৫) হিজড়াদের ‘পুরুষ’ হিসেবে ভোটাধিকারের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০০০ সালে নির্বাচন তালিকা প্রস্তুত কালে জাতীর এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হিজড়া কমিউনিটি থেকে কমিশনের কাছে আবেদন রাখা হয় ‘হিজড়া’ হিসেবে ভোটাধিকারের। জবাবে কমিশন আশ্বাস দিলেও তার বাস্তবায়ন আজও সম্ভব হয়নি।
হিজড়াদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সরকারের কাছেও নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের কোন উদ্যোগও নেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে ‘বাধন হিজড়া সংঘ’ থেকে পিংকি হিজড়া আক্ষেপ করে বলেন-
“there are no authentic statistics on how many hijras are there in Bangladesh. According to newspaper reports, the number varies from 30,000 to 150,000. Hijras get little sympathy from society. We are commonly subject to ridicule and rejection. Naturally, survival instincts make us live together as far as possible.”
তবে সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর (১৬ কোটির বেশি) দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ অর্থাৎ ৬০ হাজার হিজড়া সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে উন্মুক্ত ভাবে বাস করছে। ৫ হাজার হিজড়া পরিবারের সঙ্গে বাস করছে। তাদের বিষয়ে পরিবারগুলো গোপনীয়তা রাখে। ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার হিজড়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। শুধু ঢাকা শহরে বাস করছে ১৪০০ জন। আর খুলনা বিভাগে রয়েছে ১২০০।
আশার বিষয় সরকার প্রথমবারের মতো হিজড়া পুনর্বাসনের পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। গত বছর ২০১১ সালের ১০ আগস্ট সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মাসিক ভাতা, স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ, ক্ষুদ্রঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন সহায়তার ব্যবস্থা রেখে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে হিজড়া পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের ৬৫ হাজার হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের দুই বছর মেয়াদী এ কর্মসূচির প্রস্তাব করেছে সমাজসেবা অধিদফতর। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত। ৬৪ জেলার হিজড়া জনগোষ্ঠী এ প্রকল্পের আওতায় আসবে।
তবে পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা ও কাগজ কলমে এর পরিকল্পনার জন্য কিছু খুচরো কলমের কালির অপচয় করে তা বাস্তবায়ন না করে বসে থাকার ঐতিহ্যবাহী মানসিকতাকে সরকার বিদায় করতে না পারলে এর ফল কারো জন্যই কোন প্রকার উন্নতি বয়ে আনতে পারবে না। পাশাপাশি প্রয়োজন জনসাধারণের মনে হিজড়েদের সম্পর্কে সচেতনতা ও প্রাথমিক জ্ঞান।
অনেকের কাছেই ‘হিজড়া’ একটি গালি। কারো দুর্বলতা কিংবা ভীরুতাকে প্রকাশ করার প্রতীক রূপে অনেকেই ‘হিজড়া’ শব্দটি গালি হিসেবে প্রদান করে। যা একদিকে হিজড়েদের পক্ষে যেমন অবমাননাকর তেমনি যারা গালি দেয় তাদের মূর্খতার পরিচায়ক। হিজড়েরা দুর্বল নয়। তারা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির ফল। দুর্বল বরং আমরা যারা তাদেরকে গ্রহণ করার যথেষ্ট সাহসিকতা ও আন্তরিকতা নিজেদের ভেতর সংঘটিত করতে পারিনি।
উভলিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ভাবে পরিচিতি লাভ করা হিজড়েদের অধিকার। তবে নামের পিছনে ‘হিজড়ে’ শব্দটি যুক্ত করার যেই মানসিকতা শিখণ্ডীদের মাঝে তা পরিহার করা প্রয়োজন। কেনোনা উভলিঙ্গত্ব তাদের সার্বিক পরিচয় নয়। তাদের প্রথম ও প্রধান পরিচয় তারা মানুষ।
যৌন জীবনে হিজড়েরা মূলত সমকামী। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও সমকামিতা নিষিদ্ধ বিধায় হিজড়েদের যৌন জীবন অপ্রতিষ্ঠিত। খুবই অবাক লাগে মানুষের ব্যক্তিগত গণ্ডীর কামনা, বাসনা যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জালে আটকে থাকে এবং তাদের স্বীকৃতির অপেক্ষায় ধুকে ধুকে মরে!
হিজড়েদের প্রতিবন্ধক জীবনের পঙ্কিলতা থেকে উঠে এসে শবনম মৌসি লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন ‘স্বাভাবিক’ আমাদের থেকে তারা কোন অংশেই কম নয়। ১৯৯৯ সালে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শবনম মৌসি প্রথম হিজড়ে হিসেবে এম.এল.এ পদে অধিষ্ঠিত হন। যেখানে পশ্চিমা বিশ্বে শেরিল চেজ, জিম সিনক্লায়াররা সাধারণ মানুষের মতই স্বাভাবিক জীবনের সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে সেখানে আমাদের বৃহন্নলাদের কেন এখনও দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে স্বীকৃতির খোঁজে?
‘নপুংসক’, ‘বন্ধ্যা’ কিছু অতিরঞ্জিত শব্দের বদৌলতে মানুষকে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকত্বের সার্টিফিকেট প্রদান করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাই কি নির্ধারণ করবে কে সমাজের অন্তর্ভুক আর কে বহির্ভূত? সময়ের আর যুগের দাবী পরিপেক্ষিতে আজ এই প্রশ্ন আসা সম্পূর্ণ যৌক্তিক ও স্বাভাবিক।
চিলেকোঠার খাঁচায় ডানায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে যেই পাখিটি এখনও কাতরাচ্ছে সেও স্বপ্ন বুনে আকাশে পুনরায় ডানা মেলার। তারও পূর্ণ অধিকার আছে ফিরে যাবার তার জগতে। লাঞ্ছনা, বঞ্চনার জগত থেকে নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অস্তিত্বের বৈধতার সংগ্রাম করে চলছে বৃহন্নলারা। হাজার হাজার শিখণ্ডী চোখের দ্যুতির মাঝে স্বপ্ন লালন করে চলছে সম্মান ও সমৃদ্ধির জীবনের। এখন শুধু বাস্তবায়নের অপেক্ষা!
Wikipedia
http://men.webmd.com/tc/klinefelter-syndrome-topic-overview
http://www.medicinenet.com/turner_syndrome/article.htm
http://www.childrenshospital.org/az/Site3208/mainpageS3208P0.html
http://www.thedailystar.net/law/2008/08/04/letter.htm
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=15adf8eabe6b4c8915ef1886d46d9
সৌজন্যে @ "https://blog.mukto-mona.com/2012/04/25/25096/"